টুঙ্গিপাড়ায় একদিন

- সফুরউদ্দিন প্রভাত

টুঙ্গিপাড়ায় একদিন

“দাঁড়াও পথিক বর যথার্থ বাঙালি যদি তুমি হও। ক্ষণিক দাঁড়িয়ে যাও, এই সমাধিস্থলে। এখানে ঘুমিয়ে আছে, বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা। এ দেশের মুক্তিদাতা, বাংলার নয়নের মণি।”

এই আহ্বান আপনি পাবেন টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে গেলে। অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করতে যাব। সুযোগ পাচ্ছিলাম না। নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম বাবু সেই সুযোগটা করে দিলেন। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা মাননীয় সংসদ সদস্যের প্রতি। আড়াইহাজারের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আমিও গত পহেলা আগস্ট (২০২২ খ্রিঃ) ভোরে পায়রা চত্বর সমবেত হলাম। সঙ্গে ছিলেন বন্ধুবর মাসুম বিল্লাহ (সম্পাদক, সাপ্তাহিক আমাদের আড়াইহাজার), শাহজাহান কবির (আড়াইহাজার প্রতিনিধি, দৈনিক আমার সংবাদ ও ইসমাইল চৌধুরী (সভাপতি, বাঁচবো বাঁচাবো সমাজসেবা সংগঠন)। দিনটি ছিলো সোমবার। বিআরটিসি বাসে উফে পড়লাম। বাস ছাড়ার পূর্বে শ্রদ্ধেয় নজরুল ইসলাম বাবু এম পি মহোদয় আমাদের এসে সবার খোঁজখবর নিলেন। এমপি মহোদয়ের সাথে আমরাও চললাম টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশ্যে।

আড়াইহাজার থেকে প্রায় ১৯০ কিলোমিটার দূরে টুঙ্গিপাড়া গ্রামের অবস্থান। টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে মাত্র চার ঘণ্টায় আমরা পৌঁছে যাই গন্তব্যে। আসা যাওয়ার পথে স্বপ্নের পদ্মা সেতু এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মহাসড়ক দর্শন আমাদের দীর্ঘপথের ভ্রমণে বাড়তি পাওনা। বদলে যাওয়া বাংলাদেশের নবরূপ আমরা দেখলাম আগ্রহ ভরে।
ঢাকার যাত্রাবাড়ি অতিক্রম করার পর পদ্মাসেতু মুখী বঙ্গবন্ধু মহাসড়কে বুড়িগঙ্গা নদী এবং আড়িয়াল খাঁ নদ পেরিয়ে পদ্মার এপারে মাওয়া এবং ওপারে জাজিরা পয়েন্ট ছাড়িয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা ক্রসিং পর্যন্ত দীর্ঘপথে বেশক’টা ফ্লাইওভার- ওভারপাস- আন্ডারপাস (ভাঙ্গা ফরিদপুর জেলার একটি উপজেলার নাম)। ছয় লেনের প্রশস্ত সড়কে চলতে চলতে মনে হচ্ছিল যেন বিদেশের মাটিতে ভ্রমণ করছি। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা মোড় পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু মহাসড়কটি দেখে আমরা সবাই বেশ উৎফুল্ল। বাসের মধ্যে জনাব ইসমাইল চৌধুরীর মত যারা বিদেশে একসময় ছিলেন তারা বললেন বিদেশে বিভিন্ন মহাসড়কের চেয়ে অনেক সুন্দর ও নান্দনিক হয়েছে আমাদের এই মহাসড়ক। ভাঙ্গা থেকে টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত সড়কও যথেষ্ট ভাল। এ এলাকার সড়ক-মহাসড়ক সমূহে যানবাহনের তেমন চাপ নেই। নেই ভিড়-ভাট্টা, অসহনীয় যানজট। যা আমাদের ভ্রমণকে করে তোলে উপভোগ্য।

যাওয়ার পথে ঢাকার যাত্রাবাড়ি থেকেই আমরা পুস্পস্তবক সংগ্রহ করি। গোপালগঞ্জ জেলা শহরটি এখনো আটপৌড়ে রয়ে গেছে। মার্কেট বা বহুতল ভবনের জৌলুস নেই। অনেক টিনশেড বাড়ি ও দোকানপাট দেখলাম। মধুমতি নদীর তীরে এই জেলা শহরটি আয়তনেও তেমন বড় নয়। তবে ইতিহাস-ঐতিহ্যে বেশ সমৃদ্ধ।

মধুমতি নদীর তীরে শান্ত-সুনিবিড় এক ছায়ামাখা গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম গ্রহণ করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মধুমতির তীর ধরে জেলা সদর থেকে বিশ কিলোমিটার এগুলে টুঙ্গিপাড়া। টুঙ্গিপাড়ায় পৌঁছে পর্যটকদের জন্য রেস্ট হাউজে ফ্রেশ হওয়ার সুন্দর ব্যবস্থাপনা রয়েছে। ফ্রেস হয়ে সমাধিস্থলের উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করলাম। সমাধির প্রবেশমুখে দাঁড়াতেই বঙ্গবন্ধুর পৈতৃক বাড়িটি চোখে পড়ল। তিনতলা এই বাড়িটিতে এখন কেউ থাকেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টুঙ্গিপাড়ায় আসলে এখানেই উঠেন। এই বাড়িতেই বঙ্গবন্ধুর শৈশব কেটেছে। যদিও তখন এখানে কোন বিল্ডিং ছিল না। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বাড়ির ভিতর থেকে ঘুরে আসি। কিন্তু ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দিবে কে?
অতঃপর আমরা সমাধিতে প্রবেশের প্রস্তুতি নিলাম।
সমাধির ভিতরে বঙ্গবন্ধু’র কবর, পাশেই তাঁর বাবা-মায়ের কবর আছে। সাদা পাথরে নির্মিত গোলাকার একগম্বুজবিশিষ্ট সমাধি সৌধের চারপাশের দেয়ালে জাফরি কাটা। এই জাফরি দিয়ে সূর্যের আলো আসে। সেই আলোয় উদ্ভাসিত হয় বঙ্গবন্ধুর কবর। বঙ্গবন্ধুর কবরের কাছে আসতেই শরীরটা কেমন জানি শিরশির করে উঠল। এইখানেই শুয়ে আছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মাননীয় সংসদ সদস্য আলহাজ নজরুল ইসলাম বাবু ও দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। একে একে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজন বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করে যাচ্ছেন। আমি জাতির পিতা যেখানে শুয়ে রয়েছেন তার সমাধির পাশে যাই। সেখানে ফাতেহা পাঠ ও তিনবার দুরুদ শরীফ পড়া শেষে মোনাজাত করি। পরে বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধে পুস্পস্তবক অর্পনের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পরিকল্পিত কমপ্লেক্সের বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে দেখি। সমাধি পর্যন্ত রাস্তাটা চমৎকার। রাস্তার দুইপাশে ফুলের গাছে। চারপাশে বসার জায়গাসহ টলটলে পানির সুন্দর একটা পুকুর। সমাধি সৌধের দুই পাশের উদ্যান ছাড়িয়ে হাজার গজ এগোনোর পর বঙ্গবন্ধুর কবর। সিরামিক ইট, সাদা-কালো টাইলস দিয়ে নির্মিত নয়নাভিরাম সমাধিসৌধের স্থাপত্যশৈলীতে ফুটে উঠেছে বিউগলের সুর ও বেদনার চিত্র।

সফরসঙ্গীদের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত করা ছিল দুপুরে খাবার। শৃক্সক্ষলাসহিত খাওয়া দাওয়া শেষে ছুটলাম সমাধি কমপ্লেক্সে। সুদৃশ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে রয়েছে পাঠাগার, গবেষণাকেন্দ্র, প্রদর্শনী হল, পাবলিক প্লাজা, প্রশাসনিক ব্লক, মসজিদ, উন্মুক্ত মঞ্চ, স্যুভেনির শপ ও তথ্যকেন্দ্র। পরে লাইব্রেরী এবং প্রদর্শনী কক্ষ যেই ভবনে সেখানে যাই। লাইব্রেীর অবস্থান নিচতলায়। ছিমছাম এবং গোছানো ছোট্ট এই লাইব্রেরী দেখলেই আপনার ইচ্ছে হবে কিছুক্ষণ বসে থাকার। বঙ্গবন্ধু’কে নিয়ে লেখা বেশিরভাগ বইয়ের সংগ্রহই এইখানে আছে। মূল সংগ্রহশালা দোতলায়। ছবির সংখ্যাই বেশি। বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য জীবনের বিভিন্ন মুহূর্ত ফ্রেমে বন্দী করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়াও আছে মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরতার বিভিন্ন খÐচিত্র।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু প্রায় দশ লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ১৮ মিনিটের ঐ ভাষণে তিনি বাঙালির মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের আহবান জানান। এই ভাষণে তিনি বললেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।” ঐতিহাসিক সেই ভাষণের ছবিটি বড় করে বাঁধানো আছে।

সংগ্রহশালায় আছে সেই কফিনটি যেটিতে করে নৃশংসভাবে হত্যার পর বঙ্গবন্ধু’র নিরব নিথর দেহ বহন করে আনা হয়েছিল টুঙ্গিপাড়ায়। কফিনটা দেখে ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। এখানে কিছুক্ষন নিরবে দাঁড়িয়ে রইলাম।
সংগ্রহশালা থেকে বের হয়ে আসলাম। নিচেই আছে একটা মুক্তমঞ্চ। মাঝে মাঝে পিকনিক পার্টি আসলে এখানেই খাওয়া-দাওয়া সম্পন্ন করে। একইসাথে এখানে সেমিনার কিংবা আলোচনা সভাও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আমরা সেখানে কিছুক্ষণ বসে চাপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। আর ভাবতে ছিলাম পৃথিবীতে কোনো কোনো মানুষের জন্ম হয় ইতিহাস সৃষ্টি করার জন্য। ইতিহাস যাকে সৃষ্টি করে না, ইতিহাস যার করতলগত হয়, তেমন একজন মানুষ, প্রকৃত অর্থে যিনি মহামানব, তিনি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু থাকবেন। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী শেখ মুজিবুর রহমান। টুঙ্গিপাড়া থেকে সন্ধার আগেই বাড়ির উদ্দেশ্যে বাস ছাড়ল। যাত্রাবাড়ি পোস্তগোলা যানজটের কারণে ফিরতে রাত হলেও বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধে কাটানো দিনটিস্মরণীয় হয়ে থাকবে আজীবন। বিনম্র শ্রদ্ধা হে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান #

প্রকাশকাল: মঙ্গলবার, ২০ জুন ২০২৩, ০৪:৫৬ পিএম   ▪   হালনাগাদ: মঙ্গলবার, ২৭ জুন ২০২৩, ০৯:৫৩ এএম   ▪   পঠিত: ৩৫৮



আর্কাইভ