মৃত্যুঞ্জয়ী শেখ মুজিব

- সফুরউদ্দিন প্রভাত

মৃত্যুঞ্জয়ী শেখ মুজিব

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতির অবিচ্ছেদ্য এক সত্তার নাম। যার’ কাছে বাংলার জনগণ ছিল তার সন্তানের মতো, যাদের সুখ-দুঃখকে নিজের সুখ-দুঃখ, জনগণের অধিকার আদায়কে নিজের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ভাবতেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনী বলেছেন সে কথা-

‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’

১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে স্বাধীন বাংলার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, সেই দুঃসময়কে অতিক্রম করে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে বাঙালির কাছে ফিরিয়ে দিতে আবির্ভূত হন বিশ্বের সংগ্রামী মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বাঙালির মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। যার’ কোন উপনা নেই, কোন তুলনা নেই, কোন উদাহরণ নেই। তিনি নিজেই তাঁর উপমা, নিজেই তাঁর তুলনা, নিজেই তাঁর উদাহরণ। ‘শেখ মুজিব’ নামটির সঙ্গে মিশে আছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পলল ভ‚মির পরিচয়। শেখ সাহেব ডাকটি যেন হাজার বছরের পরাধীন বাঙালির আত্মপ্রত্যয়ের ধ্বনি। আমাদের শ্বাপদসংকুল স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অনবদ্য অভিযাত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের আবিষ্কারক। তার সংগ্রামের মহাকাব্য পঠিত হয় পৃথিবীর শতসহস্র নিরীহ, নিপীড়িত, বঞ্চিত, মুক্তিকামী জনতার হৃদয়ে, তার আদর্শ অনুপ্রাণিত করে সব অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করতে, তার নেতৃত্বে আজও বিশ্ব খুঁজে পায় স্বাধীনতার সুখ।

১৯৭১ সালে অসংখ্য বাঙালির মতোই বেশ কিছু বিদেশি নেতা ও কবি-সাহিত্যিক ছিলেন যারা বিশ্বাস করতেন, শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বেই এই দেশ স্বাধীন হবে।

এলেন্স গিন্সবার্গ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অনডিউটি ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থে মূল্যায়ন করে এভাবে লিখেছেন, ‘এমন একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে যে অনগ্রসর বাঙালি জাতিকে মুক্তির আস্বাদ দিবে। তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’

বঙ্গবন্ধুর ভাষণে একজন শক্তিমান কবির চিন্তাশক্তি, চিত্রকল্প, উপমা, শব্দচয়ন পরিলক্ষিত হয় বলেই তাকে রাজনীতির কবি হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। নিউজ উইকে বঙ্গবন্ধুকে আখ্যা দেওয়া হয়, ‘পয়েট অফ পলিটিক্স বলে’।
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান ‘বঙ্গবন্ধু এক ঐশ্বরিক আগুন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘তার সততা, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ এবং নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার প্রতিও জনগণ আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করতেন। মূলত মুজিব চরিত্রে আবেগ, বাগ্মিতা, সাহসিকতা ও ত্যাগের অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে, যার ফলে তিনি পরিণত হয়েছেন মহানায়কে।’
প্রাবন্ধিক সেলিনা হোসেন ‘৭ মার্চে ভাষণ ও বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক প্রবন্ধের একাংশে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু উপমহাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক নেতা যিনি স্বাধীনতার সঙ্গে একই সমাস্তরালে মুক্তির সংগ্রামের কথা উচ্চারণ করেছিলেন।’

বঙ্গবন্ধু বেঁচে ছিলেন মাত্র ৫৪ বছর। এর মধ্যে ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি জেলে কাটিয়েছেন। তিনি ফাঁসিমঞ্চ দেখেও ভীত হননি, আপস করেননি পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে। তিনি বাংলার মানুষকে দিয়েছেন একটি ভূখন্ড, একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, বিশ্বের বুকে গর্বিত পরিচয়। স্বাধীন বাংলাদেশে দিয়েছেন স্বাধীনতা, জাতীয় সংগীত, সংবিধান। তিনি শিখিয়েছেন সংগ্রাম, অধিকার আদায়ের দৃঢ়তা, ন্যায়ের পথে মাথা উঁচু করে বাঁচা, অন্যায়ের কাছে হার না মানা। তিনি বিশ্বময় প্রশংসিত। বিশ্ব দরবারে যার মূল্য ছিল আকাশচুম্বী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। আর এই খবর শুনে বাঙালিসহ স্তম্ভিত হয়ে পড়ে বিশ্বস¤প্রদায়।

স্তম্ভিত বিশ্বনেতারা বঙ্গবন্ধু হত্যায় তাদের প্রতিক্রিয়ায় দীর্ঘশ্বাসের পাশাপাশি হৃদয় নিংড়ানো মন্তব্য করেছেন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন- শেখ মুজিব নিহত হওয়ার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তার অনন্যসাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।
ব্রিটিশ এমপি জেমসলামন্ড বলেছিলেন- ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি, বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।’
মানবতাবাদী মনীষী লড ফেনার ব্রকওয়ে আরও একধাপ এগিয়ে দেখেছেন এভাবে, ‘জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, ডি ভ্যালেরারও চেয়েও শেখ মুজিব এক অর্থে বড় নেতা। শেখ মুজিবের সাহসিকতা ও ব্যক্তিত্ব কেবল দক্ষিণ এশিয়া নয় সারাবিশ্বে বিরল। একারণেই তিনি বিশ্বনেতা। সমগ্র বাঙালি জাতির নেতা । তিনি শুধু বঙ্গের বন্ধু নন, সারাবিশ্বেরও বন্ধু।

গত কয়েক দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক নেতার আবির্ভাব হয়েছিলো। সবার থেকে শেখ মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা হিসাবে স্বীকৃত। লেনিন, ফিদেল কাস্ট্রোর মতো বঙ্গবন্ধুও সফল নেতা ছিলেন। ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তি ও সাহসে এ মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’
ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বলছিলেন- ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’
জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনেথা কাউন্ডা বলেছিলেন- ‘শেখ মুজিবুর রহমান ভিয়েতনামী জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।’
শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার খবরটি প্রায় সব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনোই জন্ম নিত না।’
বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর পাওয়ার পর পশ্চিম জার্মানির পত্রিকায় বলা হয়েছিল, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জনগণ তার কাছে এত জনপ্রিয় ছিল যে, লুইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন যে, আমিই রাষ্ট্র।’
১৫ আগস্ট ওই ঘটনার পর বিবিসি প্রকাশ করে, ‘শেখ মুজিব নিহত হলেন তার নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে। অথচ তাঁকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচবোধ করেছে।’
ভারতীয় বেতার ‘আকাশ বাণী’ ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলে, ‘যিশু মারা গেছেন। এখন লাখ লাখ লোক ক্রস ধারণ করে তাঁকে স্মরণ করছেন। মূলত এক দিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো।’
একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়, বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।
১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে শোষক শ্রেণি, আরেক ভাগে শোষিত। আমি শোষিতের দলে।
ওই ভাষণের পর কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছিলেন, ‘তুমি আজ যে ভাষণ দিলে, এখন থেকে সাবধানে থেক। আজ থেকে তোমাকে হত্যার জন্য একটি বুলেট তোমার পিছু নিয়েছে।’ ফিদেল কাস্ত্রোর সেদিনের কথাটিই সত্য হয়ে যায় ঠিক দুই বছরের মাথায়।
দ্য গার্ডিয়ানে লেখা হয় ‘শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব’।
বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে, তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাঙ্ক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।

ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রষ্ট (১৯৭২ সালে এক সাক্ষাতৎকারে) বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার শক্তি কোথায়? তিনি অপকটে সে প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, আমি আমার জনগণকে ভালবাসি। সাংবাদিক আবারো জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার দুর্বল দিকটা কি? বঙ্গবন্ধু সে প্রশ্নের জবাবেও বলেছিলেন, আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালবাসি। বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে গভীর ভাবে বিশ্বাস করতেন।
বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করে ইয়াসির আরাফাত বলেছেন, আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ঠ্য।’
মিসরের সাংবাদিক হাসানিন হিকাল বলেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান একমাত্র বাংলাদেশের নন। তিনি সব বাঙালির জন্য মুক্তির দূত। তার বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাঙালি সভ্যতা ও সংস্কৃতির নতুন উদ্ভব। মুজিব বাঙালিদের সবসময়ের নায়ক।

পৃথিবীতে কোনো কোনো মানুষের জন্ম হয় ইতিহাস সৃষ্টি করার জন্য। ইতিহাস যাকে সৃষ্টি করে না, ইতিহাস যার করতলগত হয়, তেমন একজন মানুষ, প্রকৃত অর্থে যিনি মহামানব, তিনি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু থাকবেন। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী শেখ মুজিবুর রহমান।#

প্রকাশকাল: শুক্রবার, ১৬ জুন ২০২৩, ০১:২৩ পিএম   ▪   হালনাগাদ: শনিবার, ১৭ জুন ২০২৩, ১০:১২ এএম   ▪   পঠিত: ৩৬২



আর্কাইভ