‘কারাগারের রোজনামচা’য় বঙ্গবন্ধু ‘বই আর কাগজই আমার বন্ধু’
বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ ২০১৭ সালের মার্চ মাসে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে তাঁর বই ও সংবাদপত্র পড়ার উল্লেখ রয়েছে। বলা যায় জেলজীবনে, কারাদÐপ্রাপ্ত জীবনে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক থাকার সময়ে বই এবং সংবাদপত্র ছিল বঙ্গবন্ধুর নিত্যসঙ্গী। নির্জন নিঃসঙ্গ জীবনে তিনি বই এবং সংবাদপত্র পাঠ করে জ্ঞানার্জন করতেন, দেশ-বিদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হতেন। সংবাদপত্র পাঠ করে তিনি দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক-মনস্তাত্তি¡ক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হয়ে ম‚ল্যায়ন ও পর্যালোচনা করতেন।
বঙ্গবন্ধু ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলখানায় ১৯৬৬ সালের ২ জুন থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ও ১৯৬৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ জুন পর্যন্ত এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে (কিছু সময়ের মধ্যে) রোজনামচা লিখেছেন।
কারাগারে থাকার সময় তিনি দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, পাকিস্তান অবজারভার, মর্নিং নিউজ, দৈনিক পাকিস্তান ও অন্যান্য পত্রিকা পড়তেন। আর বিভিন্ন বই সম্পর্কেও তাঁর রোজনামচায় উল্লেখ পাওয়া যায়।
১৯৬৬ সালের ৪ জুন বঙ্গবন্ধু দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক আজাদ পড়ে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। ঐদিন তিনি একটি বইও পড়েছেন বলে ‘রোজনামচা’য় লিখেছেন :
‘বন্ধু শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক বইটি পড়তে শুরু করেছি। লাগছে ভালই, বাইরে পড়তে সময় পাই নাই।’ (পৃষ্ঠা ৬৩)
উল্লেখ্য, শহীদুল্লা কায়সার (১৯২৭-৭১) ছিলেন সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও ঔপন্যাসিক। তাঁর ‘সারেং বউ’ (১৯৬২) ও ‘সংশপ্তক’ (১৯৬৫) উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। তিনি ছিলেন সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের বড়ভাই।
১৯৬৬ সালের ১৮ জুন ‘কারাগারের রোজনামচা’য় তিনি আরেকটি বই পড়ার কথা লিখেছেন :
‘ঘরে বসে বই পড়তে আরম্ভ করলাম। এমিল জোলার লেখা ‘তেরেসা রেকুইন’ পড়ছিলাম। সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনটি চরিত্র জোলা তাঁর লেখার ভিতর দিয়ে। এই বইয়ের ভিতর কাটাইয়া দিলাম দুই-তিন ঘণ্টা সময়।’ (পৃষ্ঠা ১০১)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এমিল জোলা ফ্রান্সের ঔপন্যাসিক ও সাহিত্য সমালোচক। তাঁর জন্ম ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে এবং মৃত্যু ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ‘তেরেসা রেকুইন’ উপন্যাসটি ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন।
বঙ্গবন্ধুর ওইদিনের লিখিত রোজনামচা থেকে আরও জানা যায় যে ওই তারিখ-
‘প্রায় তিনটার সময় কাগজগুলি কয়েদি পাহারা দিয়ে নিয়ে এলো। পাকিস্তান দেশরক্ষা আইন বলে ‘নিউ নেশন প্রেস’ বাজেয়াপ্ত করিয়াছে সরকার। এই প্রেস হইতে ‘ইত্তেফাক’, ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘ঢাকা টাইমস’ ও বাংলা চলচ্চিত্র সাপ্তাহিক ‘প‚র্বাণী’ প্রকাশিত হইত। পুলিশ প্রেসে তালা লাগাইয়া দিয়াছে। ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ হইয়া গিয়াছে।’ (পৃষ্ঠা ১০২)
‘ইত্তেফাক’ ছাড়া অন্যান্য পত্রিকা সম্পর্কে জানা যায় তাঁর ‘রোজনামচা’ থেকে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন :
‘এখন আর কাগজ পড়তে বেশি সময় আমার দরকার হয় না, ‘মর্র্নিং নিউজ’-এর হেডলাইনগুলি দেখলেই বুঝতে পারি কি লিখতে চায়, ‘আজাদ’ আওয়ামী লীগের কিছু সংবাদ দেয়। ‘সংবাদ’ তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে যেগুলি দরকার তাই ছাপায়। ‘অবজারভার’ বোধ হয় একটু ভয় পেয়েছে। (পৃষ্ঠা ১০৩)
১৯৬৬ সালের ২৫ জুন এবং ২৭ জুনের ‘রোজনামচা’য়ও বই পড়ার প্রসঙ্গ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ২৭ জুন পড়া বইটি ছিল ‘একটা গল্পের বই’। (পৃষ্ঠা ১২২, ১২৩ ও ১৩০)
৩০ জুনের ‘রোজনামচা’য় লিখেছেন,
‘ভালো বইপত্র দিবে না, রিডার্স ডাইজেস্ট পর্যন্ত দেয় না। মনমতো কোনো বই পড়তেও দিবে না।’ (পৃষ্ঠা ১৩৭)
এই লেখা থেকে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধুর বই পড়ার আকুল স্পৃহা এবং পাকিস্তানি শাসকদের মনোভাব।
২ জুলাই ১৯৬৬ সালের ‘রোজনামচা’য় বঙ্গবন্ধু ভারতে মুসলমানদের বিভিন্ন ন্যায্য দাবিদাওয়া প্রসঙ্গে ১৯২১, ১৯২৪, ১৯২৮, ১৯৩০-৩১, ১৯৩৭ ও ১৯৪০ সালের ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা ‘উদ্ধৃতি’সহ উল্লেখ করেছেন। এতে তাঁর বিভিন্ন ঐতিহাসিক বইপত্র পাঠের পরিচয় মেলে। (পৃষ্ঠা ১৩৯-১৪২)
৩ জুলাই ১৯৬৬ তারিখের ‘রোজনামচা’য় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন :
‘আজ আর খবরের কাগজ আসবে না। মিলাদুন্নবীর জন্য বন্ধ। দিন কাটানো খুব কষ্টকর হবে। আমি তো একাকী আছি, বই আর কাগজই আমার বন্ধু। এর মধ্যেই আমি নিজেকে ডুবাইয়া রাখি। পুরানা ইত্তেফাক কাগজ বের করে পড়তে শুরু করলাম।’ (পৃষ্ঠা ১৪৩)
এই লেখা থেকে বঙ্গবন্ধুর কারাগার জীবনে বই এবং সংবাদপত্র কী গভীর প্রভাব ফেলেছিল তা বোঝা যায়।
১৯৬৬ সালের ২৪ জুলাই ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন গভীর বেদনার কথা :
‘বারবার আমার আব্বা ও আম্মার কথা মনে পড়তে থাকে। মায়ের সাথে কি আবার দেখা হবে। অনেকক্ষণ খবরের কাগজ ও বই নিয়ে থাকলাম। কিন্তু মন থেকে কিছুতেই মুছতে পারি না, ভালও লাগছে না।’ (পৃষ্ঠা ১৭৯)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ন‚রে আলম সিদ্দিকী ‘রক্তকপোত’ নামে একটি বই লেখার জন্যে মামলার আসামি হয়েছেন সে তথ্যটিও পাওয়া যায় ১৯৬৭ সালের ১৬-২২ এপ্রিল তারিখে লিখিত বঙ্গবন্ধুর ‘কারগারের রোজনামচা’য়। (পৃষ্ঠা ২২৫)
১৯৬৭ সালের ২৭ ও ২৮ মে তারিখে লিখিত ‘রোজনামচায়’ও রয়েছে বই এবং খবরের কাগজ পড়ার প্রসঙ্গ। একই ‘রোজনামচা’য় রয়েছে শাহ মোয়াজ্জেম লিখিত একটি বইয়ের প্রসঙ্গও। এই বইটি লেখক বঙ্গবন্ধুকে কারাগারেই পড়ে শুনিয়েছেন। বইটি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মন্তব্য ‘ভালই লিখেছে’। (পৃষ্ঠা ২৪৭) তবে বইটির নাম উল্লেখ নেই।
১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে ঢাকা সেনানিবাসে নেওয়া হয়। ওই সময় বঙ্গবন্ধু ‘বই খাতা’ রেখে যেতে বাধ্য হন। সামরিক সেনাদের কঠোর প্রহরায় নির্জন কুঠুরিতে বন্দি থাকা মৃত্যুর প্রহর গোনা অবস্থায়ও বঙ্গবন্ধু যেমন দেশ ও জনগণের কথা ভোলেননি তেমন বই এবং সংবাদপত্রের কথাও ভোলেননি। তিনি লিখেছেন :
‘কিছুই জানি না, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, সময় কাটবে কি করে? বইপত্র নাই, খবরের কাগজ দেওয়া হবে না।’ (পৃষ্ঠা ২৫৭)
‘কারাগারের রোজনামচা’য় অন্যত্র তিনি লিখেছেন :
‘আমার কাছে দুইখানা মাত্র বই ছিল। অন্য বইগুলো জেলখানায় রেখে এসেছি। ভুল করেছি বই না এনে। অফিসার ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, বই পড়তে আপত্তি আছে কি না। তিনি বললেন, বই দেওয়ার হুকুম আপাতত পাই নাই। তবে আপনার কাছে থাকলে পড়তে পারেন।… সুকর্ণর পতন সম্বন্ধে বই দুটি পড়তে লাগলাম। কিন্তু মন বসছে না, নানা চিন্তা ঘিরে ধরছে।’ (পৃষ্ঠা ২৫৮)
দুটি বই পড়ার পর বঙ্গবন্ধু সামরিক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার আকবরকে বই সরবরাহ ও বই পড়ার অনুমতি দানের অনুরোধ করেন। এই প্রেক্ষাপটে লে. ওয়ারিদ ও ডিউটি অফিসার মেজর নাঈম বঙ্গবন্ধুকে বই এনে দেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন :
‘আমি বইয়ের মধ্যে ডুবে যেতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু পারতাম না। অনেকগুলি পাতা পড়ে ফেলেছি। কিন্তু যা পড়েছি মনে নাই। আবার নতুন করে পড়তে হয়েছে।’ (পৃষ্ঠা ২৬১-২৬২)
তিনি মৃত্যুর প্রহর গোনা অবস্থায় সংবাদপত্র পাঠ করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে গ্রেফতারকৃত ২৮ জনের নাম জানতে পারেন। ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে তিনি লিখেছেন :
‘দিনগুলি কি কাটতে চায়। তবুও কাটাতে হবে। বই পেয়ে একটু রক্ষা পেয়েছিলাম।’ (পৃষ্ঠা ২৬৪)
‘কারাগারের রোজনামচা’ থেকে আরও গুরুত্বপ‚র্ণ তথ্য পাওয়া যায় যে ওই সময় সেনানিবাসের অফিসার মেসে, লাইব্রেরিতে কোনো বাংলা বই ছিল না। হেডকোয়ার্টার লাইব্রেরিতেও বাংলা বইয়ের দুষ্প্রাপ্যতা ছিল। তিনি লিখেছেন :
‘…বাংলা কথা বলার উপায় নাই- প‚র্ব বাংলার মাটিতে থেকেও- একেই বলে অদৃষ্ট! প্রাণটা আমার হাঁপাইয়া উঠছিল। সহ্য করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল বাংলা বই পাওয়ার উপায় নাই। অফিসার মেসের যে ছোট লাইব্রেরি আছে তাতে কোনো বাংলা বই নাই, সমস্ত বই ইংরেজি ও উর্দুতে।… হেডকোয়ার্টার লাইব্রেরিতে… কোনো বাংলা বই বোধ হয় সেখানে নাই।’ (পৃষ্ঠা ২৬৭)
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক।
প্রকাশকাল: শুক্রবার, ১৬ জুন ২০২৩, ১২:৪৬ পিএম ▪ হালনাগাদ: সোমবার, ১৯ জুন ২০২৩, ০৯:৩৩ পিএম ▪ পঠিত: ২৭৯