মুজিববর্ষ এবং বাংলাদেশ

- রুহুল আমিন বাবুল

মুজিববর্ষ এবং বাংলাদেশ

হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালির শ্রেষ্ঠতম অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আর এই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যার’ নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে, তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। কবিতার ভাষায় বলা যায় :
মুজিব আমার বঙ্গবন্ধু আমরা মুক্তিসেনা
তাঁর কাছে এই দেশের জন্য আমরা সবাই দেনা।
মুজিব দেশের ইতিহাসের মহাপ্রাণ এক নেতা
তাঁর ডাকেই যুদ্ধে যাওয়া-যুদ্ধ করে জেতা।
আগুনঝরা কন্ঠে ছিল পিছপা যেন না হস
৭ই মার্চের ভাষণই ছিল যুদ্ধ জয়ের সাহস।
মুজিব আমার যুদ্ধদিনের স্বাধীনতার গান
মুজিব আমার জাতির জনক বাংলাদেশের প্রাণ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ তাঁর জন্মশতবার্ষিকী। গত ১০ই জানুয়ারি মুজিববর্ষের উদ্বোধন হয়েছে। শুরু হয়েছে মুজিববর্ষ যা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপিত হবে। ২০২১ সালে উদযাপিত হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০বছর অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী।

দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশ ছিল পরাধীন। যুগ যুগ ধরে বিদেশিদের হাতে শোষিত হয়েছে এদেশের মানুষ। বাঙালির মূল্যবান সম্পদ বিদেশিরা লুটতরাজ করেছে। দখলদার ইংরেজদের কাছে শোষিক-বঞ্চিত নির্যাতিত হয়েছে এ দেশের মানুষ। ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা এদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। পাকিস্তান ও ভারত নামে দু’টি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময় বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের একটি প্রদেশ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে আমাদের অবস্থা ছিল পরগাছার মতো। ‘মুজিববর্ষ এবং আগামী দিনের বাংলাদেশ’ রচনায় মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার যথার্থই লিখেছেন “১৯৪৭ সালে একবার স্বাধীন হয়েছিলাম বলে আমাদের ধারণা হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল সেই স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর যাত্রার শুরুতেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের হাত-পা বেঁধে অন্ধকার গুহায় এবং সেখানেই চিরদিন বন্দি করে রাখার সব ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। সেই অন্ধকার থেকে মুক্তির জন্য শুরু হলো বাঙালির সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের নেতৃত্বে এলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যার পথ ধরে একাত্তরে বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার মাধ্যমে মুক্তির সোপান মাত্র রচিত হলো। যাত্রার শুরুতে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে সাবধান করলেন। বললেন, জনগণের মুক্তি না এলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাই মুক্তির পথরেখা তৈরি করলেন বঙ্গবন্ধু।”

বাংলাদেশকে স্বপ্নের সোনার বাংলা রূপে গড়ে তোলাই ছিল বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের স্বপ্ন। তারই প্রতিফলন ঘটেছিল বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণায়। ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এসেছিল সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে সরকার গঠনের সুযোগ না দিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেন। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩রা মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন-
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠে উচ্চারিত এই ঘোষণাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু করে ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকান্ড। ২৫শে মার্চ মধ্যরাত শেষে অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর পরিণতি কত ভয়ংকর হতে পারে তা তিনি জানতেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পরেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় বিজয়। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ফিরে আসেন। ১২ই জানুয়ারি তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ যখন দ্রæত অগ্রগতির দিকে চলছিল, তখনই তিনি স্বাধীনতা বিরোধী দেশীয় ষড়যন্ত্রকারী ও আন্তর্জাতিক চক্রের শিকারে পরিণত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সামরিক বাহিনীর তৎকালীন কিছু বিপথগামী সৈনিকের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শাহাদাত বরণ করেন। ষড়যন্ত্রকারীরা দৈহিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে শেষ করে দিতে পারলেও তাঁর অকৃত্রিম দেশপ্রেম, সাধারণ জনগণের প্রতি গভীর ভালোবাসা মুছে দিতে পারেনি। শারীরিকভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু হলেও তিনি অমর, অক্ষয়।

জাতি আজ মুজিব শতবর্ষ উদযাপন করছে। তাঁর আদর্শের পতাকা নিয়ে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গড়ে তুলছেন তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। এমন কোনো শক্তি নেই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে আর থামাতে পারে। আজ যে আমরা রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী পালন করি, তার উৎস জাতির জন্যে তাঁদের অবদান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপনের ক্ষেত্রে একই কথা। তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন একটি স্বাধীন দেশ, স্বাধীন জাতির মর্যাদা ও মূল্যবান আদর্শ।

আমাদের নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সম্মানিত জাতীয় সংসদ সদস্য আলহাজ নজরুল ইসলাম বাবু ঐতিহ্যবাহী মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গবন্ধু কন্যা, ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদর্শের সৈনিক। সেই আদর্শ দেশপ্রেম ও মানুষের কল্যাণের আদর্শ। নজরুল ইসলাম বাবু তার কাজের মধ্য দিয়ে সেই আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। গত কয়েক বছরে তিনি যেভাবে উন্নয়ন কর্মকান্ডের ভেতর দিয়ে আড়াইহাজার উপজেলার চেহারা বদলে দিয়েছেন, তা সত্যিই অতুলনীয়। তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। সারাদেশ আজ মুজিবর্ষের উদ্দীপনায় উজ্জীবিত। আজ মুজিববর্ষের আলোকিত পরিবেশে এই কর্মবীরকে অভিনন্দন।

বঙ্গবন্ধু নিজের স্বার্থকে কখনোই প্রাধান্য দেননি। জাতির কল্যাণের কথাই ভেবেছেন। জেল জুলুম ও নির্যাতনের কাছে তিনি কখনো মাথা নত করেননি। তাঁর আত্মত্যাগ জাতিকে মহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির অস্তিত্বের কথা ভাবা যায় না। ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘বাংলাদেশ’ আজ সমগ্র জাতির কাছে এক অভিন্ন সত্ত¡ার নাম। মুজিববর্ষে তাই কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার ভাষায় বলা যায় :
যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

প্রকাশকাল: শুক্রবার, ১৬ জুন ২০২৩, ১২:২৯ পিএম   ▪   হালনাগাদ: শুক্রবার, ১৬ জুন ২০২৩, ১২:২৯ পিএম   ▪   পঠিত: ২৫২



আর্কাইভ