বঙ্গবন্ধুই আমাদের পথ চলার শক্তি
একজন বাঙালি হিসেবে আমি গর্বিত। কারণ- আমার আছে বুক ফুলিয়ে বলার মতো অনেক গল্প। হিংস্র হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয় ছিনিয়ে আনার গল্প আছে। আছে হার না মানা বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তরের গল্প। আছে বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় গর্বের বিষয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার জন্য পেয়েছি লাশ সবুজ পতাকা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুই আমাদের পথ চলার শক্তি। তিনি আমাদের অহংকার। আমাদের জাতির পিতা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশের জন্য ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। আজ থেকে শতবর্ষ আগে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়তো সম্ভব হয়ে উঠত না। বাঙালি জাতি সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতিতে ভারতীয় উপমহাদেশে সব সময়ই অগ্রগণ্য ছিল। কিন্তু বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্র ছিল না। ছিল না মৌলিক চাহিদা পূরণের সামর্থ। কেননা পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী শাসনের নামে শোষন করে বাঙালিকে পেছনে দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু এই অনগ্রসর জাতিকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র দিয়ে জাতির হাজার বছরের পরিক্রমায় এক অনন্য স্থান অধিকার করে নিয়েছেন। তাই আমরা তাকে বলি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসত। দিনমজুর, কৃষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মেহনতি মানুষ। সাধারণ মানুষের অসাধারণ নেতা ছিলেন তিনি। বাঙালির নয়নের মণি ছিলেন। পঁচাত্তরের সেই বীভৎস ভোরে যখন জানা গেল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে, দেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের রান্নাঘরে সকালের নাশতা তৈরি করছিলেন মা। যখন শুনলেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, দিশেহারার মতো সব ফেলে ছুটে বেরুলেন। হায় হায় কয় কী! বঙ্গবন্ধুরে মাইরা ফালাইছে? কোন শয়তানরা করল এই কাজ? আমার মা তারপর কাঁদতে লাগলেন। অঝোরধারায় কান্না। পিতার মৃত্যুতে যেমন করে কাঁদে মানুষ, ঠিক সেরকম কান্না। আমরা পাথর হয়ে রইলাম।
বাংলাদেশের ঘরে ঘরে সেদিন এরকম নিঃশব্দে কেঁদেছে লাখ-কোটি মানুষ। প্রিয় নেতাকে, জাতির জনককে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে যে খুনিরা, তাদের অভিশাপ দিয়েছে। তারপর কত দিন কেটে গেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার তো দূরের কথা, তার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতে দেয়া হয়নি। বাঙালিকে লিখতে দেয়া হয়নি তাদের জাতির জনকের কথা। কিন্তু প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালি চেয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক। ফাঁসিতে ঝোলানো হোক খুনিদের। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পিতৃহত্যার বিচার করেছেন। বাঙালির বুক থেকে নামিয়ে দিয়েছেন দীর্ঘকাল ধরে চেপে বসা পাথর। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেও জাতির দায়মুক্তি করেছেন তিনি।
পঁচাত্তরের সেই দিনটির কথা আমার খুব মনে পড়ে। এত বেদনার দিন বাঙালির জীবনে আর কখনও আসেনি। বঙ্গবন্ধুর শোকে সেদিন নিঃস্তব্ধ হয়েছিল দেশের মানুষ, বইতে ভুলে গিয়েছিল আগস্ট মাসের হাওয়া, গান বন্ধ করেছিল পাখিরা, থেমে গিয়েছিল নদীর স্রোতধারা, সূর্যের তলায় এসে দাঁড়িয়েছিল ঘন কালো মেঘ। আমাদের চারিদিক ডুবে গিয়েছিল গভীর অন্ধকারে।
জাতির পিতার চিন্তা-চেতনায় সব সময় কাজ করত বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এমন একটি ব্যক্তির নাম চলে আসে, যে ওই জাতির ক্রান্তিকালে জাতিকে সঙ্কট থেকে মুক্তির দিশা দেখিয়ে উত্তরণের পথে নিয়ে যায়। এমন একজন মহামানব বা মহান ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নামই নয়, একটি মুক্তির পথ, একটি বিশ্বাসের নাম। তিনি ছিলেন বাঙ্গালি জাতির পথ প্রদর্শক ও জাতির মুক্তির নায়ক। বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখার সুযোগ আমার হয়নি. কারন ১৯৬৭ সালে আমার জন্ম। আমার বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম মাজহারুল হক দিদার (১৯৫৫-২০০৩) বঙ্গবন্ধু ডাকে মুক্তি সংগ্রামে অংশ্র গ্রহণ করেছিলেন। দিদার ভাইয়ের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু কথা শুনে আমি মহানায়ককে গভীর শ্রদ্ধায় ভালোবেসে ফেলি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জীবনী পাঠ করে তাঁর মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পড়ি। তাঁরই গড়া ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতির মধ্য দিয়ে আমার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। তারপর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে পরপর তিনবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য সারা দেশের মত আমার জন্মস্থান আড়াইহাজারকে উন্নত জনপদে পরিণত করতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছি।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট ঘাতকরা যদি জাতির জনককে হত্যা না করতো তাহলে আমাদের মত প্রজন্মদের হয়তবা এই বিশাল মনের মহানায়কের সান্নিধ্য পাবার সুযোগ হতো। এই আপসোস শুধু আমার একার নয়, আমাদের মত নতুন প্রজন্মদের সন্তানদের আজীবন এই আপসোস বহন করে চলতে হবে। তবুও আমার শৈশবের লালিত স্বপ্ন কৈশোরের উচ্ছ¡াস, যৌবনের অনুভূতি, ভালোলাগা ও-ভালোবাসার প্রাণের সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের স্কুলজীবন থেকে বঙ্গবন্ধুর একজন আদর্শিক গর্বিত-ছাত্রলীগ কর্মী হিসাবে কাজ করার যে সুযোগ হয়েছিলো-এজন্য নিজেকে ধন্য ও সৌভাগ্যবান মনে করছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখতে না পারলেও ১৯৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট হত্যাকান্ডের খুনীদের বিচারের আন্দোলনের রাজপথের সৈনিক হিসাবে ছাত্রজীবনে লড়াই সংগ্রাম করেছি। হয়েছে বিচার, এটাই আমার রাজনৈতিক জীবনের পরম পাওয়া।
ঘাতকচক্র জাতির পিতাকে হত্যা করলেও তার নীতি ও আদর্শকে মুছে ফেলতে পারেনি। তার আদর্শ রয়ে গেছে আমাদের চেতনায়। তিনি আমাদের চলার শক্তি। তিনি হচ্ছেন বাঙালির জাতির আকাশ। আকাশ সব সময় মাথার উপরে থাকে। তিনি আছেন আমাদের মাথার উপর। তার দেখানো পথ আর আদর্শ আমাদের চালিত করছে। বঙ্গবন্ধুর জন্য বাঙালি জাতি চিরকাল কাঁদবে। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন তার নাম এ দেশের লাখো কোটি মানুষের অন্তরে চির অমলিন, অক্ষয় হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশ আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে- বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই, বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ ধরেই। বাংলাদেশ আজ উন্নয়ন ও অগ্রগতির মহাসড়কে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, মেট্টো রেল, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নসহ আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচকে এ দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মুজিববর্ষ পালনের মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে আমরা যেমন বঙ্গবন্ধুর অবদান অক্ষয় করে রাখব, তেমনই আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির অঙ্গীকার নতুন করে শানিত করব। বঙ্গবন্ধু শত জেল-জুলুম সয়েও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন। একটি সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত বাংলাদেশ গঠনে আমাদের সবার অবদানই হবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ঋণশোধের সামান্য প্রচেষ্টা।
প্রকাশকাল: শুক্রবার, ১৬ জুন ২০২৩, ১২:১৩ পিএম ▪ হালনাগাদ: শুক্রবার, ১৬ জুন ২০২৩, ১২:২৪ পিএম ▪ পঠিত: ৬০৫